আমি শহরতলির শেষপ্রান্তের বাড়িটাতে বাস করি। একতলা পাকাবাড়ি, খুপরির মতো কেবল একটা ঘর। ভাড়া খুব কম। মালিক বিদেশ থাকেন। তিনি গ্রামসূত্রের এক ভাই। বাড়িটা এতো ছোট যে সেটা হয়তো ৩০টা মুরগি রাখার একটা পাকাঘরের মতো। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে তার দেশের অ্যাকাউন্টে আমার ভাড়া জমা দিতে হয়। এটি আমি নিজ দায়িত্বে করি। বিশ্বাস ভঙ্গ করে ডেরা হারাতে চাই না। তার সাথে এমনকি আমার ফোনেও মাস ছয়েক যোগাযোগ হয়নি। বিশ্বস্ত কাউকে পাননি বলেই হয়তো আমাকে এই বাড়ির দায়িত্বে রেখেছেন। এই বাড়ির সবচেয়ে কাছের বাড়িটাও আধমাইল দূরে। বলতে পারেন আমার একমাত্র বিলাসিতা এই বাড়িটায় একা থাকা। সাবলেট না দেওয়া। এ বিলাসিতা আমি হারাতে চাই না। আমার দুটো প্যান্ট। একটা ধুয়ে দিলে আরেকটা পরে অফিস, কাজকাম করি। এর বাইরে আমার চারটি শার্ট, দুটো গেঞ্জি, একটা লুঙ্গি, দুটো আন্ডারপ্যান্ট, একটা পায়জামা, একটা গামছা এবং একটা গার্লফ্রেন্ড আছে।
আমি করি সেলসের চাকরি। আসলে সেলস বললে খুব বড় চাকরি বোঝায়। আমি দোকানে দোকানে ভিউকার্ড আর স্টিকার বেঁচি। ভিউকার্ডের দিন শেষ, মফস্বল অঞ্চলে স্টিকারের দিন কিছুটা এখনো আছে। এক পাতায় ২৫টা স্টিকার থাকে। একপাতা স্টিকার দোকানে বিক্রি করতে পারলে আমার লাভ থাকে ১০টাকা। আমার দিনে ইনকাম ১০০ টাকার কাছাকাছি। এর বাইরে আমি মাঝে মাঝে এটা-সেটা বেঁচি। কিন্তু এক বছরে আমার গড় আয় কখনোই এমন জায়গায় পৌঁছায়নি যে আমি আর দুটো প্যান্ট কিনবো। প্রথমেই বলেছি আমাকে এরপরও অফিস করতে হয়। হ্যা দোকানে দোকানে বিক্রির আগে এবং বিক্রির শেষে আমাকে স্টিকার মালিকের বাসার লাগোয়া ড্রয়িং রুমে গিয়ে অফিস করতে হয়। মালিক খুব কড়া। হাজিরা না দিলে চাকরি নট!
কখনো কোনও মাসে নানা ধান্দামান্দা করে যদি আয় রোজগার একটু বেশি হয়ে যায় তাহলে আমি গার্লফ্রেন্ডের সাথে ফোনে একটু বেশি কথা বলে, একটু বেশি ডেটিং করে, একটু কিছু তাকে কিনে দিয়ে- দিনানিপাত করি। আমার সৎ মা রয়েছেন, বড় দুই ভাই রয়েছেন। তাদের ব্যাপারে আমাকে খুব মাথা ঘামাতে হয় না। মাসে খুব সামান্য টাকা পাঠিয়ে দায় রক্ষা করি। এমনিতে আমি যে নিমকহারাম নই- এটা তার প্রমাণ। দিনে চারটা সিগারেট খাই খুব কমদামি। তবু প্রেমিকার সাথে দেখা করলে সে চটপটি খেতে খেতে বলে- তোমার সিগারেট খাওয়াটা একটু কমাও, অনেক বাজে খরচ করো। গত মাস পাঁচেক আমি শত চেষ্টা করেও দুটোর বেশি তিনটে প্যান্ট কিনতে পারছিলাম না। একজন সেলসম্যানের অবশ্যই পর্যাপ্ত ভালো প্যান্ট ও শার্ট থাকতে হয়। শার্ট আমার কিভাবে কিভাবে যেন আছে বা এখন না কিনলেও চলবে। কিন্তু প্যান্ট কেনাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
এই যেমন ধরা যাক, কিছুদিন আগে বৃষ্টি হলো। একটা প্যান্ট ধুয়ে দিয়েছিলাম। টানা বৃষ্টি পড়ায় তিনদিনেও সেটি শুকালো না। ফলে আরেকটা প্যান্ট কাদা-পানি লাগিয়েই আমাকে তিনদিন পরতে হলো। তারপরও ভাবছিলাম দেখি কতোদিন যায়। জন্ডিস-মন্ডিস বলে, প্রেমিকার সাথে দুমাস দেখা না করলে হয়তো একটা প্যান্ট কেনার টাকা জমিয়ে ফেলতে পারবো। কিন্তু প্রেমিকা আমার বাড়ি চেনে। আমার এ বাড়িতে বেশ কয়েকবার বিয়ের পরে যা যা করে সেটা করেছি। কাজেই হুট করে চলে এলে মিথ্যা ধরা পড়ে যাবে।
মাঝে মাঝে নিয়তি উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সেদিন স্টিকার বিক্রি করতে গিয়ে মফস্বল শহরের এক লোকাল বাসে উঠেছিলাম। এধরনের বাস কেমন তা বলে আর সময় নষ্ট করতে চাই না। সিট ফাঁকা পেয়ে হুড়মুড় করে বসতে গিয়ে সিটের বেরিয়ে থাকা পেরেকে প্যান্টের রানের দিককার অনেকখানি ছিঁড়ে গেল! খুব অদ্ভুত হলো এর পরেরদিন আমার বাকি প্যান্টটা ছাদে নাড়া ছিল সেটিও চুরি হয়ে গেল। সাথে একটি শার্টও। আপনাদের যাদের অনেক প্যান্ট আছে তারা হয়তো ব্যাপারটা শুনে হাসছেন। কিন্তু যার দুটোই মাত্র প্যান্ট এবং যে কিনা সেলসের চাকরি করে, তার দুটো প্যান্ট ইজ ইকাল্টু গরীব কৃষকের দুটো গরু!
কেননা লুঙ্গি বা পায়জামা পরে স্ট্রিট ফুড বেঁচা গেলেও স্টিকার বেঁচা যায় না। যেকোনও সৌখিন জিনিস বেঁচতে হলে আপনার প্যান্ট থাকতে হবে। উপায় না দেখে স্টিকার কম্পানির মালিকের কাছে পায়জামা পরে গেলাম। কিছু টাকা ধার চাইলাম। তিনি আমাকে তিনমাসে কমিশন কেটে রাখার শর্তে টাকা ধার দিলেন। তবে টাকা দেওয়ার আগে তার স্ত্রীর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ মাসে কয় হাজার টাকার কেনেন, স্টিকার ব্যবসাটা যে তিনি আর করবেন না, কে কে টাকা ধার নিয়ে তার কাছ থেকে আর ফেরত দেয়নি ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কেচ্ছাকাহিনী শোনালেন।
স্টিকার কম্পানির মালিকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার দুটো প্যান্ট কেনার জন্য মার্কেটে যাবো ভাবছিলাম। একটু দরদাম করে কিনলে হয়তো তিনটে প্যান্টও কেনা যাবে। আমি ঠিক জানিনা তারপরও কিছু টাকা বাঁচালে হয়তো একটা সাদা শার্ট। এগুলো জরুরী। স্টিকার কোম্পানির মালিক জানেন না একমাস পরে আমি চাকরি বদল করবো। জর্দা বিক্রি করার জন্য চায়ের দোকানদার খুব নামি এক জর্দার কোম্পানির সেলসে ঢুকিয়ে দিবে বলেছেন। জর্দা বিক্রিতে প্রচুর টাকা। ওই চাকরিটা মোটামুটি ফাইনাল। কাজেই তিনমাসে স্টিকার মালিকের টাকা আমি দিয়ে দিতে পারবো। নেমক হারাম নই আমি। টাকা বালিশের নিচে রেখে ঘুমালাম। পরদিন খুব সকালে প্যান্ট কিনতে মার্কেটে যাওয়ার পথে বহু পুরনো একটা স্মৃতি মনে এলো। আমি মুচকি হাসলাম। দুপুর নাগাদ হাসতে হাসতে দুটো নতুন প্যান্ট কিনে বাড়ি এলাম। আপনারা শুনলে অবাক হবেন, মালিকের ধার দেওয়া টাকা থেকে আমি প্যান্ট দুটো কিনিনি। কিনেছি কেবল একটা শার্ট।
গার্লফ্রেন্ডকে ফোন দিয়ে বললাম আজ সিনেমা দেখাবো। সে খুব খুশি হলো। ভাবছেন কিভাবে করলাম এতোকিছু। ওই যে একটা স্মৃতি মনে পরে গেল। আমাদের মফস্বল শহরে ‘নুনু পাগলা’ নামে এক পাগল ছিল। জনাকীর্ণ মার্কেটটার সামনে লিঙ্গ উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো। কতোবার যে তাকে মার্কেট সমিতি জামা প্যান্ট কিনে দিয়েছে, কতোবার মেরে খেদিয়ে দিয়েছে- তার ইয়ত্তা নাই। কিন্তু পাগলা প্রত্যেকবারই কাপড় কিনে দেওয়ার দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের মাথায় আগের বেশেই আবার খাড়া হয়ে যেত মার্কেটের সামনে। কখনো মারধর খেয়ে খুব আহত হলে হয়তো সপ্তাহখানেক দেখা যেত না।
আমি আজ অন্য এক মফস্বলে গিয়ে (ওটি আমার বিক্রির এলাকা না) সবচেয়ে বড় মার্কেটটায় ওভাবেই ঢুকেছিলাম। আর পরনের জামাকাপড় এক ঝোপে লুকিয়ে রেখেছিলাম। মার্কেট কর্তৃপক্ষ আমাকে দুটো প্যান্ট দিয়েছে। সম্ভবত নারী-পুরুষ দুই ধরনের ভদ্র কাস্টমারদের হারানোর ভয়ে।
আসলে উলঙ্গ না হলে অভাব বোঝানো খুব কঠিন। এখনকার পৃথিবী বাহ্যিক নগ্নতাকে খুব গুরুত্ব দেয়, বুঝলেন! আমি একজন সেলসম্যান, আজ নিজের নগ্নতা বিক্রি করেছি মাত্র।
লেখক: Tonmoy Imran