মেয়েটার ছবি দেখার পর থেকে মইনুলের বুকের ভিতর চিনচিন শুরু হয়েছে। জীবনে এই প্রথমবারের মতো তার মনে হচ্ছে- সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এটা কি তার বয়সের দোষ? মইনুল একজন লেখক। না, কবি নয় সে। কেবল ঝরঝরে গদ্য লিখে জীবনের ৪০ বছর পার করে দিয়েছে। থাকে নিঃসন্তান বোন-দুলাভাইয়ের বাসায়। খায়-দায়-ঘুমায়। সরকারি সেকেন্ড ক্লাস চাকরি করতেন দুলাভাই৷ সদ্য রিটায়ার করেছেন। আর বোনটা মইনুলের চেয়ে ১৫ বছরের বড়।
যাহোক এ যুগেও একটা জীবন যে কোনোরকম কাজ ছাড়া, কাজের ছদ্মাবরণে লিখে কাটিয়ে দেওয়া যায়- তার প্রমাণ মইনুল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় ডিগ্রি নেওয়ার পরও সে কখনো চাকরি খোঁজেনি। একটা জীবন সে লিখে কাটাবে বলেই ঠিক করেছিল। ঠিক করলে তো হবে না! মইনুলের লেখনি ঝরঝরে হলেও গল্প বা থিম সাধারণ মানের। গল্পগুলো ক্লিশে। একটা ছোট গল্পের বই বের হয়েছিল এক যুগ আগে, ৫০০ কপি। সেটার নাকি এখনো ৩০ কপি পড়েই আছে প্রকাশকের কাছে।
মইনুল নিজেও ইদানিং বোঝে তার লেখায় তেমন কিছু নেই। তবু মাঝে মাঝে এ পত্রিকা সে পত্রিকায় দৌড়াদৌড়ি করে লেখা ছাপায়৷ কখনো গল্প, কখনো ফিচার ছাপা হয়। স্পট রিপোর্টিং, ভ্রমণকাহিনীও লিখে মইনুল। উচ্চমানের সাহিত্য রচনার স্বপ্ন তার বছর পাঁচেক আগেই নিভু নিভু হয়ে গেছে। পত্রিকাগুলো থেকে যৎসামান্য যে বিল পায়, তা দিয়ে চা সিগারেটের খরচ হয়৷ তবে এমন তো হতেই পারে যেকোনো সময় জীবনের সেরা লেখাটি বিদ্যুচ্ছটার মতো আলোক ছড়িয়ে মইনুল লিখে ফেলতে পারে! এমন তো কত কবি-সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই হয়েছে।
তাছাড়া বোন ও দুলাভাই তো আছেনই৷ দুলাভাই বারবার কাজের খোঁজ নিয়ে আসেন। আসলে মইনুল দুলাভাইয়ের দায়- ঠিক আর্থিক দায় নয়, মইনুলের প্রতি তিনি একধরনের পিতাসুলভ দায় অনুভব করেন। এই আলাভোলা ছেলেটা এমন বেকার থাকলে, তিনি মারা গেলে তো বিপদে পড়ে যাবে।
প্রৌঢ়ত্বে পা দেওয়া মইনুলকে নিয়ে তিনি হাল ছাড়েন না। দুলাভাই কাজের খোঁজ আনলে বা চাকরি ঠিক করলেই মইনুল মুখটা চুন করে বলে- দুলাভাই, লেখা ছাড়া তো আর কিছু পারিনা।
লন্ডন প্রবাসী ধনী বন্ধুর কন্যার সাথে মইনুলের বিয়ের প্রস্তাবটাও নিয়ে আসেন দুলাভাই। মেয়েটার বয়স ২৮৷ লন্ডনেই থাকে। দুলাভাইয়ের বন্ধুর এই মেয়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। সেই ছেলেও বেকার ছিল। লন্ডনে যাওয়ার পর মতিগতি পরিবর্তন হয়। বিয়ের দুইবছরের মাথায় বোঝা যায় আসলে সিটিজেনশিপই তার মূল লক্ষ্য ছিল। সে যাই হোক, মইনুল যে সেরকম ছেলে না এই কথা প্রবাসী ভদ্রলোক প্রায় নিশ্চিত। তিনি নিজে একরকম চেপে ধরেছেন মেয়ের সাথে মইনুলের বিয়ে দেওয়ার জন্য। কেননা লন্ডনে তার গ্রোসারি শপ সামলাতে অবশ্যই একজন বাধ্যগত জামাতা লাগবে৷
লোভনীয় প্রস্তাবটা আপার সামনেই দিয়েছিলেন দুলাভাই। আপা তো শুনেই লাফাতে শুরু করেছিলেন। মইনুল সেই পুরনো কথায় তুললো- দুলাভাই আমি তো লেখা ছাড়া কিছু পারি না!
দুলাভাই অত্যন্ত বিরক্ত হলেন এবার- “তোমার ফোর্থ ক্লাস লেখা পড়ছি আমি। কি যেন… ও হ্যা ‘পার্কের বেঞ্চিতে মিলেছিল দুই হাত’ টাইপ লেখা। ওই জিনিস এখন আর চলে! লেখালেখির লাইনে তোমার আর হবে না।”
মইনুল বোঝে তার হয়তো সত্যি কালোত্তীর্ণ কিছু লেখা হবে না৷ তবু লেখা ছাড়া সে আর কিছু পারে না!
ডাক্তার যদি নাম-যশ খ্যাতি নাও পায়, তবু তো সেটা করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয়৷ সেতো আর গান গেয়ে টাকা কামায় না! শিক্ষক পড়াতে না পারলেও, শিক্ষকতাটা করে যান। তাহলে তার লেখা অতি সাধারণ মানের হলেও, লিখে যাওয়াতে ক্ষতি কী!
দুলাভাই আর আপা বলেন- আরে পাগল বিয়ে করলে লিখতে পারবি। বিয়ে কর, সেটা তো আর চাকরি না। মইনুলের তর্ক করতে ইচ্ছা করে না। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে একটু হাঁটবে, বসন্তের ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ে লাগাবে বলে। তার একটু ভাবা দরকার।
ইতিমধ্যে বোন-দুলাভাই মইনুলকে লন্ডনপ্রবাসী মেয়েটার ছবি দেখিয়েছে। মেয়েটি দেখতে সুন্দর। টানা টানা চোখ। মইনুলের ধারণা সে কোনও কাজ না করে লিখতে চাইলেও হয়তো বিয়েতে রাজি হবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে শ্বশুরের গ্রোসারি শপে তো বসা হবে না! আর তা না হলে শ্বশুর মশাই কেন তার সাথে মেয়ে বিয়ে দেবেন!
মেয়েটার কথা ভাবতেই ভারতেই মইনুল তার পরিচিত চায়ের দোকানে আসে। এক কাপ চা খেয়ে সিগারেট ধরায়। বরাবরের মতো তার সামনে বসে আছে পরিচিত মুখের এক ভিক্ষুক। রাতের বেলায় বসে সারাদিন কয়টাকা পেল তার হিসেব মেলাচ্ছে৷
মইনুল কোনোদিন এই ভিক্ষুকের সাথে কথা বলেনি। দোকানদার প্রায়ই ভিক্ষুককে জিজ্ঞাসা করে- তোমার আজ কয়ট্যাকা হইলো ভিক্ষা করে?
ভিক্ষুক দোকানির কথার উত্তর দেয়। মাঝে মাঝে মইনুলসহ যারা চায়ের দোকানে বসে থাকে তাদের আপসোস করে শোনায়- ভিক্ষা করে তার আসলে ইনকাম অন্যদের চেয়ে অনেক কম। শহরের ভিক্ষুকদের ৯৯ ভাগের অর্ধেকের সমান তার আয়। এসময় তার মুখটা মলিন দেখায়।
মইনুল তার চেহারার দিকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে। দেখতে বুড়োটে হয়ে গেলেও ততোটা বয়স নয় এই ভিক্ষুকের। তার চেয়ে বড়জোর বছর তিন-চারেকের বড় হবে। শরীরে কোনো খুঁতনেই। মইনুলের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়- কোনও ধরনের শারীরিক ত্রুটি নেই, তাহলে এই লোক ভিক্ষা করে কেন?
সে ভাবে হয়তো উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে না। শরীরের ভেতর কোথাও ঝামেলা আছে৷ এক সময় চায়ের দোকানের অন্যান্য কাস্টমার চলে যায়। কেবল মইনুল আর ভিক্ষুকই থেকে যায়। এই ফাঁকে একটু কথা বলা যায়, ভাবে মইনুল। –
জিজ্ঞাসা করে- চাচা (চাচা তার বলার কথা না, মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়) আপনি কি অসুস্থ?
– না তো!
– আপ্নার শরীর স্বাস্থ্য ঠিক, তবু ভিক্ষা করেন ক্যান?
– আর কিছু তো পারি না। দুইবার রিকশা চালাইতে গেলাম- চুরি হয়ে গেল! দিন মজুরির কামটা ভাল্লাগে না৷ শরীরেত জুইত হয় না।
– ভিক্ষা করে ভালোই ইনকাম করেন?
– আরে নারে ভাই, লোকে আমাক ভিক্ষা দেবার চায় না৷ কয় শরীরের কোথাও খুঁত নাই, কাম করে খাওনা ক্যান মিয়া!
এই পর্যন্ত বলে ভিক্ষুক একটু থামে৷
বলে- আমিও ভাবি, শরীরের খুঁত থাইক্লে, কিংবা ওই গলাটলা ভালো হইলে ভিক্ষা বেশি পাতাম। মনা মিয়ার মতো মুখ বাঁকায়ে অভিনয় জানলেও তিনগুণ ট্যাকা বেশি পাতাম। রমিজের বাপের মতো ভদ্রলোক চেহারা হলেও লোকে মনে করে বাপরে তার পোলা ঘর থেইকা বাইর কইরা দিসে, আহারে… ভিক্ষা দেয়।
ভিক্ষুক ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মইনুলকে আচমকা জিজ্ঞাসা করে- আপ্নে কী করেন?
মইনুল সিগারেটে টান দিয়ে বলে- আমি তো লেখালেখি করি।
ভিক্ষুক আবার জিজ্ঞাসা করে- পত্রিকায়? সাংবাদিক?
মইনুল উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন না মনে করলেও উত্তর দেয়- না, লিখি। লেখক।
ভিক্ষুক বলে- লিখেন ক্যান?
– অন্যকিছু পারি না বলে।
ভিক্ষুক একটা বাকা হাসি দিয়ে নিজের পথ ধরে। তার কণ্ঠস্বর শোনা যায়- বুঝছি, আমার মতোই কোনও কাম পারেন না।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে মইনুলের বুকের চিনচিনে ব্যথা হারিয়ে যায়। সে লন্ডনপ্রবাসী মেয়েটাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।